‘সত্যম শিবাম সুন্দরম’ সিনেমায় শশী কাপুর ও জিনাত আমান। আইএমডিবি
সত্তরের দশকের এক সাহসী পদক্ষেপ
বলিউডের সোনালী যুগে হাতে গোনা যে কয়েকজন নির্মাতা প্রথাগত ধারণা ভাঙার সাহস দেখিয়েছিলেন, রাজ কাপুর তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৭৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত তাঁর সিনেমা ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ সেই সাহসিকতারই এক জ্বলন্ত নিদর্শন। তবে মুক্তির পর এটি যে মাত্রার বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল, তা বলিউড ইতিহাসে বিরল। নির্মাতার নাম যখন রাজ কাপুর, তখন তাঁর ছবিতে সাহসী দৃশ্য থাকা অস্বাভাবিক ছিল না, কিন্তু ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ মুক্তির পর সেই বিতর্ক এতটাই চরমে পৌঁছায় যে, প্রখ্যাত অভিনেতা-নির্মাতা দেব আনন্দ সরাসরি ছবিটির সমালোচনা করেন এবং গায়িকা লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে নির্মাতার সম্পর্কের দূরত্ব তৈরি হয়।
‘সত্যম শিবাম সুন্দরম’ সিনেমায় শশী কাপুর ও জিনাত আমান। আইএমডিবি
আলোচনার কেন্দ্রে বিতর্কিত দৃশ্য
ছবিটির মূল চরিত্র ‘রূপা’য় অভিনয় করে অভিনেত্রী জিনাত আমান যেমন বিপুল প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন, তেমনি জড়িয়েছিলেন বিতর্কেও। বিতর্কের প্রধান সূত্রপাত ছিল ছবির ‘সাইয়াঁ নিকাস গায়ে’ গানটির দৃশ্যায়নকে ঘিরে। এটি ছিল নায়িকা রূপা (জিনাত আমান) ও নায়ক শশী কাপুর অভিনীত প্রথম রাতের দৃশ্য, যা রাজ কাপুর অত্যন্ত সাহসী ভঙ্গিমায় উপস্থাপন করেছিলেন।
জিনাত আমানের পোশাক ও দৃশ্যটিতে তাঁর শারীরিক ভঙ্গিমা সে সময়ের ভারতীয় দর্শকদের কাছে ছিল অস্বাভাবিকভাবে খোলামেলা। বিশেষ করে একটি দৃশ্যে তাঁকে প্রায় উন্মুক্ত অবস্থায় দেখানোর কারণে অনেকে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ছবিটির বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ ওঠে। হিমাচল প্রদেশের এক ব্যক্তি রাজ কাপুরের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করেন, অভিযোগের বিষয় ছিল—ছবিটি অশালীন এবং নামের মধ্যেই অশালীনতা লুকিয়ে আছে। অনেকেই রাজ কাপুরের বিরুদ্ধে নারীর শরীরকে ‘আধ্যাত্মিকতা’ ও ‘নির্মলতার’ আড়ালে ব্যবহার করার অভিযোগ তোলেন।
‘সত্যম শিবাম সুন্দরম’ সিনেমায় শশী কাপুর ও জিনাত আমান। আইএমডিবি
দেব আনন্দ ও লতা মঙ্গেশকরের প্রতিক্রিয়া
সমালোচনার ঢেউ যখন তুঙ্গে, সেই সময়ে অভিনেতা-নির্মাতা দেব আনন্দও নিজের ক্ষোভ চেপে রাখতে পারেননি। তাঁর ‘দেশ পরদেশ’ ছবিটি একই সময়ে মুক্তি পেয়েছিল এবং তাঁর ক্যারিয়ারকে নতুনভাবে উজ্জীবিত করে তুলেছিল। সাংবাদিক বীর সাংঘভি তাঁর আত্মজীবনী ‘আ রুড লাইফ’-এ উল্লেখ করেছেন, দেব আনন্দ ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’কে ‘অশ্লীল ছবি’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। তাঁর ভাষায়, “এটি একটি অশ্লীল ছবি। ক্যামেরা বারবার জিনাতের শরীরের ওপর কেন্দ্রীভূত হচ্ছে? অশ্লীল!”
অন্যদিকে, ছবির গানগুলো লতা মঙ্গেশকর গাইলেও, সংগীত পরিচালকের বিষয়ে মতবিরোধের জেরে রাজ কাপুর ও তাঁর মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন তৈরি হয়, যা তাঁদের দীর্ঘদিনের সম্পর্কে দূরত্ব সৃষ্টি করে।
নির্মাতার দার্শনিক ব্যাখ্যা ও বক্স অফিস সাফল্য
বিতর্কের মুখে রাজ কাপুর তাঁর ছবিকে দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছিলেন। বীর সাংঘভি তাঁর বইয়ে লিখেছেন, মুম্বাইয়ের আরকে স্টুডিওতে এক আলোচনায় রাজ কাপুর বলেছিলেন, বিষয়টি কে কীভাবে দেখছেন, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। জিনাতের চরিত্রের সংবেদনশীল দৃশ্যগুলো নিয়ে তাঁর স্পষ্ট মন্তব্য ছিল: “যাঁরা জিনাতের শরীর দেখতে আসবেন, তাঁরা বের হয়ে আমার ছবির কথা মনে রাখবেন।”
এত সমালোচনা সত্ত্বেও ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ বক্স অফিসে দারুণ সাফল্য পেয়েছিল এবং সময়ের সঙ্গে এটি বলিউডের অন্যতম প্রতীকী ও সাহসী সিনেমা হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নেয়।
জিনাত আমানের স্মৃতিচারণ: ‘খুবই সংযত’ চুম্বন
বছর কয়েক আগে অভিনেত্রী জিনাত আমান নিজেই ইনস্টাগ্রামে ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন। তিনি ছবির প্রথম অনস্ক্রিন চুম্বন দৃশ্যটি শেয়ার করে লেখেন, “ছবির চুম্বন দৃশ্য নিয়ে হুলুস্থুল হয়েছিল, তবু তা ছিল খুবই সংযত।” তিনি আরও জানান, শুটিংয়ের সময় তাঁর একটুও অস্বস্তি লাগেনি।
অভিনেত্রী জানান, শশী কাপুরের সঙ্গে তাঁর কাজের অভিজ্ঞতা ছিল স্বপ্নের মতো। স্কুলে থাকতেই শশী কাপুরকে প্রথম দেখেন এবং তিনি ছিলেন “প্রত্যেক স্কুলছাত্রীর স্বপ্ন” ও “সবার ক্রাশ”। এমনকি মুম্বাইয়ে অভিনয়ে আসার আগে শুধু তাঁকে একঝলক দেখার আশায় তিনি বান্ধবীদের নিয়ে হাঁটার অজুহাতে তাঁদের বাসার কাছে যেতেন।
শশী কাপুর ও জিনাত আমান পরবর্তীতে ‘রোটি কাপড়া ওউর মকান’, ‘চোরি মেরা কাম’, ‘বকিল বাবু’ সহ একাধিক ছবিতে একসঙ্গে কাজ করেছেন। জিনাতের ভাষ্যমতে, শশী কাপুর ছিলেন বুদ্ধিদীপ্ত, রসিক ও দারুণ এক মানুষ, যাঁর উষ্ণতা ও হাসি চারপাশের সবাইকে প্রাণবন্ত করে তুলত। জিনাত আরও জানিয়েছিলেন, ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’-এ তাঁকে কাস্ট করার পর রাজ কাপুরের স্ত্রী কৃষ্ণা কাপুর শুভেচ্ছা স্বরূপ তাঁর হাতে একমুঠো সোনার কয়েন তুলে দিয়েছিলেন।